আরবি বছরের প্রথম মাস মুহাররম।আরবি বারটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাসকে হারাম বা সম্মানিত বলে কুরআন শরিফ ও হাদিস শরিফ-এ ঘোষণা করা হয়েছে, মুহাররম মাস তার মধ্যে অন্যতম।আসমান-জমিন সৃষ্টিকাল হতেই এ মাসটি বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে আসছে। এ মাসেরই দশ তারিখ অর্থাৎ ১০ই মুহাররম “আশূরা” দিনটি বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত দিন।সৃষ্টির সূচনা হয় এই দিনে এবং সৃষ্টির সমাপ্তিও ঘটবে এ দিনেই।বিশেষ বিশেষ সৃষ্টি এ দিনেই করা হয় এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনাও এ দিনেই সংঘটিত হয়।
ইতিহাসে আশুরা
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজী (সাঃ) বললেন, এটি কি? তারা বলল, এটি একটি ভাল দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা আ. রোজা পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর নবীজী (সাঃ) রোজা রেখেছেন এবং আমাদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বলেছেন তোমরা আহলে কিতাবদের বিপরিদ কর তারা একটি রোজা রেখেছে তোমরা ১০ তারিখ ঠিক রেখে দুইটি রাখো (৯,১০ অথবা ১০,১১) [বুখারি]
আশুরার রোজার ফজিলত
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সাঃ) কে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং এই মাস অর্থাৎ রমজান মাসের রোজার প্রতি। [বুখারি]
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররম (মাসের রোজা)। [সহিহ মুসলিম]
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। [সহিহ মুসলিম]
এটি আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার করুণা। তিনি একটি মাত্র দিনের রোজার মাধ্যমে পূর্ণ এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।
আশুরা তাৎপর্য
১০ই মুহাররম হযরত আলী রা. এর নয়নমণি নবী তনয় ফাতিমার রা.-এর কলিব্জার টুকরা ইমাম হুসাইনের স্বপরিবারের উনিশজন সদস্যসহ তাঁর বাহাত্তরজন অনুসারীকে যেভাবে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করতে হয়েছিল কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়কে যে ব্যথিত করবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর তাই মুহাররম মাসের আগমনে নতুন করে মুসলমানদের হৃদয়ের নিভৃতে মুহররমের নির্মম স্মৃতি যেন সকল ঐতিহাসিক ঘটনাকে ম্লান করে দেয়। ঈমানদার মাত্রই এহেন নির্মম ঘটনায় মর্মাহত হবে এবং হওয়াই ঈমানের দাবী।
আমাদের কিছু সংখ্যক অজ্ঞ মুসলমান কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাকে স্মরণ করে নিজেদের মনগড়া কিছু কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে এই দিনের তাৎপর্যকে নষ্ট করে। ঐদিন তারা তাজিয়া তৈরি করে পথ ঘাটে বুক থাবরিয়ে মাতম করে। ইমাম হুসাইনের কৃত্রিম কবর তৈরি করে অনৈসলামিক ‘কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়।
আসলে আশুরার দিনে যারা তাজিয়া তৈরি করে পথে প্রান্তরে পর্তন কুর্দন ও অন্যান্য অনৈসলামিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইমাম হুসাইন রা. এর স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাকে লোক চোখে তুলে ধরতে চায় তা ইসলাম সমর্থন নয় ।
যদিও অনেকের ধারণা কারবালার শোকাহত ও মর্মস্পশী ঘটনাই মুহাররম মাসের বৈশিষ্ট্য। আসলে তা ঠিক নয়। পৃথিবীর শুরু থেকেই মাহে মুহাররম দশম দিবস অতি পূণ্যময় ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ মাসটি অত্যন্ত সম্মানীত ও মর্যাদাপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত। জাহিলিয়াতের যুগেও আরবের মুর্খরা এ মাসটিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিত। এমনকি এ মাসকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচনা করে অন্যায়, অবিচার, জুলুম-অত্যাচার, ঝগড়া-বিবাদ, দাঁঙ্গা-হাঙ্গামা, রাহাজানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলতো।
আশুরা শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর জন্যই নয় বরং পূর্ববর্তী উম্মতের কাছেও একটি ফজিলতপূর্ণ দিন হিসাবে বিবেচিত হতো।
বস্তুতঃ অতীতে আশুরা দিবসে বহু স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে, কেননা আদিকাল থেকে যুগে যুগে আশুরা দিবসে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কথা বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা জেনেছি আল্লাহ্ রাববুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাউহু মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টি জীবের আত্মাসৃজন করেন, সে দিনটি ছিল ১০ই মুহাররম তথা আশুরা দিবস। শুধু তাই নয় বরং আদম আ. এর সৃষ্টির দিন ও ছিল ১০ই মুহারম, হযরত নূহ আ. এর জাহাজ ৮০জন সহচর নিয়ে যেদিন নিরাপদে জুদী পর্বতে অবতরণ করেছিল সে দিনটিও ছিল ১০ই মুহাররম। এভাবে হযরত ইউসুফ আ. এর কুপ থেকে উদ্ধার। আয়ুব আ. এর আরোগ্য লাভ, হযরত ইউনুস আ. এর মৎস উদর হতে মুক্তি লাভ, মূসা আ. এর পরিত্রাণ, হযরত ইবরাহিম আ. নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে মুক্তি পেয়ে ছিলেন যে দিনটিতে সে দিনটিও ছিল ১০ই মুহাররম। শুধু কী তাই? বরং ঐদিন অর্থাৎ ১০ইং মুহাররমেই হাশর ও কিয়ামত সংঘটিত হবে বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
বস্তুতঃ যে আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য ইমাম হুসাইন রা. একদিন কারবালার প্রান্তরে শহিদ হয়ে ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই আদর্শকে আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে। আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে ইসলামি মূল্যবোধকে জাগ্রত করার শপথ গ্রহণ করতে হবে। ঐদিন তাজিয়া নিেিয় নর্তন-কুর্দন করার দিন নয়। আমাদের প্রত্যেককেই ঐ দিনটির যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। আর তখনই মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে যখন আমরা এ মাসের ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা থেকে শিক্ষণীয় , বর্জনীয় ও করণীয় বিষয় এবং তার আদর্শ ও কার্যকলাপ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রিয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারবো।
আশুরার আমল
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আশুরা-মুহররমের দশম দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে- ১. আশূরা উপলক্ষে দুটি রোজা রাখা। অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ। শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখা মাকরূহ। ২. সম্ভব হলে উক্ত দিনে যারা রোজা রাখবে তাদের এক বা একাধিক জনকে ইফতার করানো। ৩. সাধ্যমত দান-সদকা করা। ৪. গরিবদেরকে পানাহার করানো। ৫. ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো তথা পাশে দাঁড়ানো।
আশুরার সাথে তাসুআর রোজাও মুস্তাহাব
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এটিতো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আগামী বছর এদিন আসলে, আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাল্লাহ। বর্ণনাকারী বলছেন, আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গিয়েছে।
ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সাথীবৃন্দ, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেননা নবী করিম (সাঃ) দশ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং নয় তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।
তাসুআর রোজা মুস্তাহাব হবার হিকমত
ইমাম নববি রহ. বলেন, তাসুআ তথা মুহাররমের নয় তারিখ রোজা মুস্তাহাব হবার হিকমত হলো-
এক. এর উদ্দেশ্য হল, ইহুদিদের বিরোধিতা করা। কারণ তারা কেবল একটি অর্থাৎ দশ তারিখ রোজা রাখত।
দুই. আশুরার দিনে কেবলমাত্র একটি রোজা পালনের অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে তার সাথে অন্য একটি রোজার মাধ্যমে সংযোগ সৃষ্টি করা।
তিন. দশ তারিখের রোজার ক্ষেত্রে চন্দ্র গণনায় ত্রুটি হয়ে ভুলে পতিত হবার আশংকা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে।
এর মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী তাৎপর্য হচ্ছে, আহলে কিতাবের বিরোধিতা করা। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বহু হাদিসে আহলে কিতাবদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করেছেন। যেমন আশুরা প্রসঙ্গে নবীজী বলেছেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই নয় তারিখ রোজা রাখব।
আশুরায় উদযাপিত কিছু বিদআত
আশুরার দিন লোকেরা জারিগান, হালুয়া-রুটি, কালো কাপড় পরিধান সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে এ সম্বন্ধে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. কে প্রশ্ন করা হল, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না?
জবাবে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদযাপন প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকে সহিহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবাদের থেকেও না। চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ও সাহাবাদের থেকে কোনো সহিহ কিংবা জয়ীফ হাদিসও বর্ণনা করেননি। তাবিয়ীদের থেকেও কোনো আছর পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে হযরত ইমাম হাসান-হোসাইন রা. এর নামে যেভাবে বুক চাপড়ানো, রক্তাক্ত করা, তাজিয়া মিছিল করা ইসলামে এর কোন কিছুরই গ্রহণযোগ্যতা নেই। তবে একটি হাদিসে আছে আশুরার দিন ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা।
শেষ কথা: তাই আসুন আমরা যেন আশুরার গুরুত্ব সঠিক ভাবে বুজে আমল করার তৌফিক যেন আল্লাহ সুবানাহুতালা আমাদের দান করুন। এবং সকল প্রকার বিদআতি কাজ পরিহার করে সুন্দর ভাবে যেন পরকালের কাজ করতে পারি মহান মালিক যেন আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন!!!
লেখক: প্রবন্ধকার, তরুণ আলেম
Leave a Reply